Acting in Ray’s Film

মানিকবাবুর অ্যাক্টিং / রাজা ভট্টাচার্য

এক

“…হ্যাঁ, অভিনয় যা আমরা শিখেছি, ওদের কাছ থেকেই শিখেছি।”

অন্যান্য অনেক উদ্ধৃতি বা ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে, ‘নায়ক’ ছবির অরিন্দমের এই একটি সংলাপ-টুকরোর মধ্যে দিয়েই বোঝা যায় যে সত্যজিৎ রায় হলিউড দ্বারা বিপুলভাবে প্রভাবিত ছিলেন। কারণ, এখানে সহযাত্রী অ্যামেরিকান ইন্ডাস্ট্রির গুণকীর্তন করছিলেন। সেখান থেকেই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির কথা ওঠে। আর অ্যামেরিকান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি বলতে এখনও আমরা হলিউডকেই বুঝি।

আবার ‘নায়ক’ উত্তমকুমারও ছিলেন হলিউডি ছবির পোকা। প্রসঙ্গত, উত্তমকুমারের বাবা ছিলেন ‘মেট্রো’ সিনেমার অপারেটর। বাবার সঙ্গে দিনের পর দিন গিয়ে কিশোর অরুণ দেখতেন তৎকালীন হলিউডি সিনেমা। তাই হলিউডি অভিনয় ধারা তাঁর কাজের ওপর বিশেষ প্রভাব ফেলেছে ; তিনি খুব সযত্নে এবং যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে তাঁর অগ্রজদের অভিনয়ের প্যাটার্ণ থেকে দূরে গিয়ে নিজস্ব একটা অ্যাক্টিং প্যাটার্ণ তৈরি করতে সফল হয়েছিলেন। এর আগের সফল নায়করা, যেমন – বিকাশ রায়, প্রদীপ কুমার, অসিতবরণ প্রমুখেরা প্রধানত প্রমথেশ বড়ুয়ার সফল উত্তরসূরি হয়ে উঠতে চেষ্টা করতেন। কিন্তু আমাদের তরুণ অরুণ কিছু আলাদা হতে চেয়েছিলেন।

তবে সত্যজিতের  ‘নায়ক’ ছবির পর তাঁর অভিনয় ভাবনায় আমূল পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। মনে রাখতে হবে যে ‘নায়ক’-এর আগে উত্তমকুমারের কেরিয়ারের ১৮টি বছর কেটে গেছে। এখন তিনি একাধারে ‘ম্যাটিনি আইডল’ এবং অনেক অনুজ অভিনেতার পথপ্রদর্শক। এখনও বাংলা ছবির ‘স্টার’ বলতে তাঁকেই বোঝায় – এটা অনস্বীকার্য। সত্যজিতের ভাষায় –“নায়ক আমি লিখেছি উত্তমকুমারের কথা ভেবেই।” কারণ, তিনি ভালো করেই জানতেন যে, ‘অ-নায়ক’ যে-কোনও সুঅভিনেতাকে নিলেও দর্শক মেনে নেবে না। কারণ, নিজের কেরিয়ারে যিনি ‘স্টার’ নন, তাঁকে পর্দায় স্টার বানানোটা অতিরঞ্জন। মনে রাখতে হবে, ‘স্টার’ কথাটিও কিন্তু হলিউড থেকে আমরা পেয়েছি। মানেটা খুব পরিষ্কার। ‘নায়ক’ ছবির নায়ক হিসেবে উত্তমের কোনও বিকল্প সত্যজিতের হাতে ছিল না। কিন্তু ওই একটি ছবিই একজন ‘স্টার’-এর বাকি কেরিয়ারের অভিনয়রীতিকে এমন প্রভাবিত করল যে তিনি নায়ক থেকে অভিনেতায় উন্নীত হবার চেষ্টা করলেন। ১৮ বছরের সফল কেরিয়ারে, রূপালি জগতের মধ্যগগনে থাকা সূর্য এখন যেন অনেকটাই মেঘমুক্ত। একদা যে-ভুল তিনি করেছিলেন, ‘নায়ক’-এর মাধ্যমে তিনি শুধু সেটা শুধরে নিলেন না, হলিউড থেকে নেওয়া অভিনয়সূত্রগুলির প্রয়োগে আরও সচেষ্ট হলেন।

কী ভুল? পঞ্চাশের দশকে সত্যজিৎ রায় ‘ঘরে-বাইরে’ করবেন ভেবেছিলেন। সন্দীপের চরিত্র করার জন্য উত্তমকুমারকে অনুরোধ করেন। কিন্তু উত্তমবাবু তখন সংখ্যার হিসেবে সেঞ্চুরি করা নায়ক, তাঁর আশেপাশে স্তাবকের বলয়। তরল আড্ডায় তারা উত্তমকে বোঝাল যে, সন্দীপ চরিত্রটি ভিলেন, সেটা করলে গুরুর নায়ক ইমেজ চটকে যাবে। উত্তম ফোন করলেন পরিচালককে এবং সটান জানিয়ে দিলেন যে কোনও ভিলেন চরিত্রে অভিনয় করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। সত্যজিৎও ছবিটির ভাবনা তখনকার মত মুলতুবি রাখেন।

কিন্ত্য তারল্য বেশিদিন থাকে না, বয়ে যায়। স্তাবকরাও। তখন ‘মহানায়ক’ বুঝতে পারেন যে স্তাবকদের পাল্লায় পড়ে কী মারাত্মক ভুল করে ফেলেছেন! আর তাই ‘নায়ক’ দিয়েই সে-ভুল শুধরে নিলেন তিনি। ছবিটি নির্মাণের পরে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিমানভরে সত্যজিৎকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “মানিকদা, আপনি অরিন্দমের চরিত্রে আমায় নিলেন না কেন?” মানিকবাবুর সাফ জবাব, “তুমি তো আর নায়ক নও”।

এটা ঠিকই যে সৌমিত্র অন্যের অনেক ছবিতে হিরোর ভূমিকায় কাজ করলেও, মানিকবাবুর তোশিরো মিফুনে তিনিই। সত্যজিৎ-সৌমিত্র জুটির যে-সব ফসল আমরা পাই তাতে দেখা যায় যে সেখানে সৌমিত্রকে আমরা অভিনেতা হিসেবেই পাই। দেখতে পাই, তাঁকে দেওয়া চরিত্রগুলির মধ্যে কোনও রিপিটেশন নেই। বরং এক চরিত্র থেকে অপরে যাওয়ার, অভিনেতাকে ভেঙে নতুন করে চরিত্রনির্মাণের এক প্রবল প্রচেষ্টা। আর এখানেই ‘অভিনেতা’ সত্যজিৎ রায় প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন।

সৌমিত্রবাবু-সহ সত্যজিতের অনেক অভিনেতাকেই এটা বলতে শুনেছি যে নির্দেশক সত্যজিৎ এমনভাবে স্ক্রিপ্ট পড়তেন – চরিত্রের সমস্ত ডিটেল আর সাবটেক্সট নিয়ে – তাঁর সিকিভাগও যদি অভিনেতা ক্যামেরার সামনে করতে পারতেন, তাহলেই কেল্লা ফতে। তাহলে কী সেই অভিজ্ঞান? শুধুই কি শুধু হলিউড, নাকি ইউরোপ ও প্রাচ্যের অভিনয় রীতিও প্রচ্ছন্ন প্রভাব ফেলেছিল ‘অভিনেতা’ সত্যজিতের মননে?